Sunday, 1 September 2019

লোরকা ও দালি শৈল্পিক বন্ধুত্বের উপাখ্যান

হোমপেজআর্টস হোমসাক্ষাৎকারপ্রবন্ধঅনুবাদ

গদ্য, প্রবন্ধ, বিশ্বসাহিত্য

লোরকা ও দালি: শৈল্পিক বন্ধুত্বের উপাখ্যান

MANZUR_SAMS |  2 OCT , 2013  

কার্ল মার্কস-ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস, আব্রাহাম লিঙ্কন-জসুয়া স্পিড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে- গারট্রুড স্টেইন এবং আরো অনেক বিখ্যাত বন্ধুত্ব মানবসভ্যতাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। সে তালিকায় উজ্জ্বল এক বন্ধুত্ব সালভাদর দালি আর ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার বন্ধুত্ব। তবে এ বন্ধুত্বে রয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা– বিরহ। হরীতকীর কষের মতো সে তেতো সঞ্জীবনী তাদের নিজ নিজ কাজকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। ঋদ্ধ হয়েছে বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য। ঊনবিংশ শতকে শিল্পকলা ও সাহিত্যে বিশ্ব তোলপাড় করা এই দুই স্প্যানিশ প্রতিভার কিংবদন্তি বন্ধুত্ব এখনো শিল্প-সাহিত্য রসিকদের উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত করে। ২০০৮ সালে ‘লিটল অ্যাশেস’ নামে একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে।

সালভাদর দালির পুরো নাম সালভাদর দোমিঙ্গো ফেলিপ জ্যাকিন্তো দালি ই দোমেনেক (জন্ম ১১ মে, ১৯০৪; মৃত্যু ২৩ জানুয়ারি, ১৯৮৯)। স্যুরিয়ালিস্ট ধারার বিশ্বখ্যাত এই চিত্রশিল্পীর ব্যক্তিত্বও সবাইকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত।

ফেদেরিকো দেল সাগরাদো কোরাসন দে হেসুস গার্সিয়া লোরকার জন্ম ১৮৯৮ সালের ৫ জানুয়ারি। স্পেনের এই বিশ্বখ্যাত কবি, নাট্যকার ও নাট্য পরিচালককে ১৯৩৬ সালের ১৯ অগাস্ট জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়ারা গুলি করে হত্যা করেছিল।

সালভাদর দালি ও গার্সিয়া লোরকার ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের শুরু ১৯২৩ সালে। দালি তখন সবেই মাদ্রিদে এসে অ্যাকাডেমি অব সান ফার্নান্দোর স্পেশাল স্কুল অব ড্রয়িংয়ে ভর্তি হতে স্প্যানিশ সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান রেসিদেনসিয়া দে এস্তুদিয়ান্তেস ছাত্রাবাসে ওঠেন। প্রথম দেখাতেই লোরকা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন অপ্রচলিত-অদ্ভুত পোশাকের দালিকে দেখে। আর লোরকাকে দেখে দালি হন বিমুগ্ধ । লোরকাকে প্রথম দেখার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে দালি বলেন, ‘যেন আগাপাছতলা এক কবি-প্রতিকৃতি হঠাৎ রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল’। পরস্পরবিরুদ্ধ ব্যক্তিত্বের হলেও এবং শিল্প-সাহিত্য নিয়ে দুজনের ভেতর প্রায়ই ধুন্ধুমার তর্ক লেগে গেলেও দালি ও লোরকা দ্রুত একে অন্যের বন্ধু হয়ে ওঠেন এবং লোরকা রেসির সামাজিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে দালিকে সহায়তা করেন। দালি ছিলেন খুব লাজুক আর লোরকা ছিলেন হাসি-গানের এক অফুরান উৎস। এ সময় এক ছাত্র-বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় দালিকে বহিষ্কার করা হয় এবং বাড়ি গিয়েও সেখানকার এক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়ায় তাকে এক মাস হাজতবাস করতে হয়। এই চিত্রশিল্পী ১৯২৪ সালে আবার রেসিতে ফিরে আসেন নতুন এক ক্ষ্যাপামো নিয়ে, যা প্রগতির পুরোধাদের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

সে সময়ের বিজ্ঞানের ছাত্র এবং পরবর্তীতে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা লুইজ বানওয়েলসহ অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে; সুরাপানে, ধূমপানে মেতে থেকে একজন আরেকজনকে পড়ে শুনিয়ে, ইয়ার্কি মেরে, হেসে-খেলে রেসির সেই দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছিলেন লোরকা ও দালি। লোরকা ও বানওয়েল নানদের মতো পোশাক পরে ট্রামের যাত্রীদের নাকাল করে ছাড়তেন এবং তারা সবাই বানওয়েলের তলেদো সহমর্মিতা সঙ্ঘে যোগ দিয়েছিলেন। লোরকা ও দালি এ সময় বস্তাপচা, সেকেলে ও কালবিরুদ্ধতার একটি তালিকা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হতে থাকা এই দুই সঙ্গীর বন্ধুত্ব ক্রমেই পারস্পরিক শ্রদ্ধায় জারিত হয়ে গাঢ় হতে থাকে এবং তাদের এক অপরের প্রতি ভলিবাসাও প্রগাঢ় হতে থাকে।

১৯২৫ থেকে ১৯২৭ সাল নাগাদ দিন যতই যাচ্ছিল ততই তারা একে অন্যের ভক্ত হয়ে উঠছিলেন এবং এতে তাদের একজনের কাজের ওপর অন্যজনের প্রভাব পড়ছিল। ১৯২৫ সালে লোরকা যখন দালি এবং তার পরিবারের সঙ্গে বার্সেলোনার ঠিক উত্তরে উপকূলীয় গ্রাম কাদাকেসে দালিদের গ্রীষ্মকালীন বাড়িতে ইস্টারের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন তখন তিনি সেই গ্রামটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তারা সারা শহর হেঁটে হেঁটে, দালির সুন্দরী বোন আনা মারিয়ার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করে করে, সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়িয়ে এবং একে অন্যের কাজ খুঁটিয়ে দেখে দেখে সময় কাটাচ্ছিলেন। লোরকা তার ‘মারিয়ানা পিনঞেদা’ নাটকটি পড়ে শোনানোর পর পরিবারটির ‘দ্বিতীয় পুত্র’ হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীতে দালি বার্সেলোনায় নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনীর জন্য মঞ্চের ডিজাইন করেছিলেন। এই পরিবারটি যখন তাদের ফিগেইরোস শহরের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল লোরকা তখন তার নাটক ও কবিতা পড়ে শোনানোর জন্য তাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। কিন্তু শিগগিরই লোরকা গ্রানাদাতে তার বাড়িতে চলে যান। পরের বছর গ্রানাদা ও মাদ্রিদে ছোটাছুটি করে বেড়ানোর সময় প্রিয় বন্ধুর ভীষণ অভাব বোধ করতে থাকলেন। অগত্যা চিঠি লিখে দালির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন এবং এ সময়টাতেই তাদের দুজনের কাজ খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিল। ১৯২৭ সালের গ্রীষ্মে লোরকার ‘মারিয়ানা পিনঞেদা’ নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনীর জন্য তারা দু বন্ধু আবার একসঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন। এরপর তারা কাদাকেস-এ গিয়েছিলেন। সেখানে কিছু একটা হয়েছিল, যার জন্য হঠাৎ করেই লোরকা গ্রানাদায় ফিরে গিয়েছিলেন। শিগগিরই দালি এক বছরের জন্য স্পেনের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং দীর্ঘদিনের জন্য এই দুই বন্ধু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ‘লুইস দে গঙ্গোরা’ উৎসবে যোগ দিতে এবং এ উৎসবের জন্য কাজ করতে লোরকা আবার মাদ্রিদে ফিরে আসেন। এখান থেকে আবারো তিনি গ্রানাদার বাড়িতে ফিরে যান এবং বুঝতে পারেন দালির সঙ্গে তার সম্পর্কটা এমনভাবে পাল্টে গেছে, যার আর পরিবর্তন সম্ভব নয়। ১৯২৮ সালে তারা একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। দুজনের দুটি পথ ভিন্ন দিকে চলতে থাকে। শুধু ১৯৩৫ সালে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাদের আবার দেখা হয়েছিল।

চিত্রকর্ম ও কবিতার ক্ষেত্রে এই দুজনের নিজস্ব আলাদা সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও এবং তারই পরিণামে দুজন দুজনের কাজের সমালোচক হয়ে উঠলেও ১৯২৩ থেকে ১৯২৮ সালের ভেতরে তাদের নিজ নিজ কাজে বেশ ভালোভাবেই একে অন্যের ওপর প্রভাবিত ছিলেন। রেসিতে দালি ও লোরকার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার গোড়ার দিকেই তারা দুজনে সর্বাধুনিক চিত্রকলা, সাহিত্য ও সঙ্গীতে প্রভাবিত হয়েছিলেন (যার ভেতরে ছিল আমেরিকান জাজ-সঙ্গীত এবং বাস্টার কিটোনের চলচ্চিত্রও)। দুজনেই তখন একে অন্যকে আধুনিকতায় টানছিলেন। ইউরোপ প্রগতির যে পথিকৃতের ভূমিকা রাখছিল, তাতে একে অন্যকে আগ্রহী হয়ে উঠতে ইন্ধন জোগাচ্ছিলেন। শিগগিরই তাদের দুজনের কাজে এর প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। লোরকা তার বিখ্যাত ‘সালভাদোর দালির উদ্দেশে গীতিকবিতা’টি লিখেছিলেন ১৯২৫ সালে– দালির সঙ্গে প্রথম দীর্ঘ বিচ্ছেদের সময়ে। এ কবিতায় শিল্পী দালির প্রতি লোরকার গভীর অনুভূতি যেমন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, তেমনি দালির চিত্রকর্মের ‘কিউবিস্ট আইডিয়াল’ এবং বাস্তবতার নির্মোহ, বিশ্লেষণাত্মক প্রকাশ এ কবিতাকে করে তুলেছে দৃঢ়, কর্তৃত্বপূর্ণ। এ সময়ের দালির চিত্রকর্মে হাত-পা-মাথাহীন দেহ, বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং পচে যাওয়া জীব-জন্তুর দেহের মাঝে লোরকার মাথা থাকাটা প্রায় অবধারিত হয়ে উঠেছিল, যেমনটি দেখা যায় তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘লিটল অ্যাশেস’ এবং ‘হানি ইজ সুইটার দ্যান ব্লাডে’ এবং তিনি তার নিজের মাথার ওপর দিয়ে প্রলম্বিত করে লোরকার মাথা আঁকতে শুরু করেন।

দালি যখন আরো বেশি বেশি লেখালেখি করতে শুরু করেন, লোরকা তখন বেশি বেশি ছবি আঁকতে শুরু করেন এবং ১৯২৭ সালের জুনে বার্সেলোনার ডালমাউ গ্যালারিতে লোরকার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী আয়োজনে দালি তাকে সহায়তা করেন। এই প্রদর্শনীতে লোরকার চিত্রকর্মগুলোতে দালির কিউবিস্ট নন্দনতত্ত্ব এবং স্যুরিয়ালিজমের প্রতি প্রবল কৌতূহলই কেবল প্রতিফলিত হয়নি, শিল্পের প্রতি তাদের পারস্পরিক গভীর বোঝাপড়াটাও প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। এ সময় তারা একে অন্যকে লেখা চিঠিপত্রে যেসব মোটিফ ও ছবি আঁকতেন তাতে তাদের এক নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। ‘আপনাআপনি লেখা ও ছবি আঁকা’র মতো একই রকমের স্যুরিয়ালিস্ট টেকনিকের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তারা একসঙ্গেই। লোরকার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে উৎসাহের উৎস ছিলেন দালি। শুধু তাই নয়, দালি লোরকার নাটকগুলো এবং গ্রন্থগুলোর ভূয়সী প্রশংসায় সব সময় পঞ্চমুখ থাকতেন।

যাই হোক, ১৯২৮ সাল নাগাদ এই দুই বন্ধুর কাজে তাদের আগের সব কাজের এবং নন্দনতাত্ত্বিক ধারণার বিরুদ্ধ-ধারা প্রতিফলিত হতে থাকে। দালির চিত্রকলায় ফুটে উঠতে থাকে বাস্তবতা, বাস্তবতা ও অতিবাস্তবতার অদ্ভুত পাশাপাশি অবস্থান, অ্যান্টি-আর্ট, বস্তুর বহিরাবরণ এবং অবশ্যই পচন-বিরোধিতা, যা কিনা ইতিহাস-অনুবর্তী। অন্যদিকে লোরকা তখনো জীবনের সারবত্তা আবিষ্কারে আগ্রহী থেকে যান। শিল্পের রহস্য পাঠে মগ্ন থেকে প্রগতির পুরোধা ও স্যুরিয়লিজমের প্রতি অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও ফিরিয়ে আনতে প্রয়াসী হন তার আন্দালুশীয় পিতৃভূমিতে শেকড়-প্রোথিত কাস্তিলীয়-পূর্ব অতীত। লোরকা তার ১৯২৭ সালে লেখা গদ্য কবিতা ‘সেন্ট লুসি অ্যান্ড সেন্ট লাজারাসে’ উপরিকাঠামো ও গভীরতার ভেতর, স্পষ্টতা ও রহস্যময়তার ভেতরের দ্বিবিভাজন শৈল্পিক সুষমায় তুলে ধরেন, যার উপমাগুলোর প্রতিটিই ছিল বিতর্কের একেকটা প্রতীক।

এ সময়ে দালি ক্রমেই লোরকার সাহিত্যকর্মের সমালোচক হয়ে ওঠেন– বিশেষ করে তার জিপসী গীতিকবিতা ‘আন্দালুশিয়ান অল্টারপিসে’র। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বরে দালি লোরকাকে তার বিতর্কিত কাব্য-সঙ্কোলন ‘ট্র্যাজিক টেল’স অব লাইফ অ্যান্ড ডেথ’ এবং ‘সেনসুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড ব্যারোক ডিলাইট টু দ্য হিউম্যান বডি’-এর সমালোচনা করে সাত পৃষ্ঠার একটি চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি কাব্যগ্রন্থ দুটিকে ‘ঘনদর্শনমূলক এবং প্রচলিত ধারণার অনুগামী’ এবং ‘পুরোপুরিই ঐতিহ্য-অনুগত’ বলে বর্ণনা করেন। যাই হোক, এই বিরোধী প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি দালি চিঠিতে লোরকাকে এও লেখেন যে, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি, কারণ তোমার কাব্যগ্রন্থ তোমাকে এভাবে প্রকাশ করেছে।’ আর দালি বিশ্বাস করতেন যে লোরকা তার সাহিত্যকর্মে এমন হাস্যরস, সাংঘাতিক ভয়ঙ্করিতা ও কাব্য-সুষমার সন্নিবেশ অব্যাহত রাখবেন, যা অন্য কোনো কবি পারবেন না।

দালি ও লোরকার এই বিচ্ছেদের কী কারণ সে সম্পর্কে খুব কম তথ্য জানা গেলেও এটা স্পষ্ট যে, তাদের সম্পর্কে চিড় ধরার পেছনে ছিল তাদের পরস্পরের প্রতি সমকামী অনুভূতির ভয় ও অস্বস্তি, যা কাটিয়ে উঠতে দুজনেই হিমশিম খাচ্ছিলেন। লোরকা সেই ১৯২৫ সালের গ্রীষ্মেই এই শিল্পীবন্ধুর প্রতি তার সমকামী ভালবাসা টের পেয়েছিলেন এবং ক্যাথলিক সমাজের রক্তচক্ষুর ভয় তাকে ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছিল। বিশেষ করে ক্যাথলিক সমাজে সমকামিতাকে বিকৃত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করা হয় বলে। এর সঙ্গে যৌনতার প্রতি তার ব্যক্তিগত ভয়ও কাজ করছিল। দালিও লোরকার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং এই মোহ তাকে খুব সমস্যায় ফেলে দিচ্ছিল। এ সময়ে লেখা তাদের দুজনের চিঠিতে পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগের পাশাপাশি একজনের প্রতি অন্যজনের ভালবাসার কারণে অস্বস্তিও প্রতিফলিত হয়েছে। দালি তার প্রতি লোরকার যৌন-আকাংখাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্যারিসে চলে যান।

১৯২৬ সালে ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র অল্প কয়েকদিন আগে উত্তেজনা ছড়ানোর দায়ে তাকে অ্যাকাডেমি অব সান ফার্নান্দোর স্পেশাল স্কুল অব ড্রয়িং থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ সময়েই তার আঁকা বাস্তবানুগ চিত্রকর্ম ‘দ্য বাস্কেট অব ব্রেড’ ব্যাপক প্রশংসিত হয় এবং তা চিত্রকর্মে তার দক্ষতা প্রতিফলিত করে। এ বছরই তিনি প্রথমবারের মতো প্যারিস ভ্রমণ করেন এবং তার সাক্ষাৎ ঘটে কিংবদন্তি শিল্পী পাবলো পিকাসোর সঙ্গে, যাকে তিনি পরম শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন। পিকাসো এরই মধ্যে আরেক বিখ্যাত শিল্পী জোয়ান মাইরোর কাছ থেকে দালির অনেক প্রশংসা শুনেছেন। কয়েক বছরের ভেতরেই দালি তার নিজস্ব অঙ্কনরীতি প্রতিষ্ঠা করলেও এ সময়ে তার আঁকা বেশ কয়েকটি চিত্রকর্মে পিকাসো ও মাইরোর বেশ বড় এক প্রভাব লক্ষ করা যায়।

১৯২৯ সালে দালি তার স্যুরিয়ালিস্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা বন্ধু লুইস বুনুয়েলকে স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র ‘উন চিয়েন আন্দালু’ (অ্যান আন্দালুশিয়ান ডগ) নির্মাণে সহযোগিতা করেন। এ বছরই দালির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার ভবিষ্যত স্ত্রী গালার, যার পুরো নাম ছিল এলিনা ইভানোভা দিয়াকোনোভা। গালা ছিলেন এক রুশ অভিবাসী এবং বয়সে দালির চেয়ে দশ বছরের বড়। সে সময়ে তিনি স্যুরিয়ালিস্ট কবি পল এলুয়ার্ডের স্ত্রী ছিলেন। সে বছরই দালি তার কয়েকটি পেশাবৃত্তিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন এবং প্যারিসের মন্টপারনাসে স্যুরিয়ালিস্ট দলে যোগ দেন। এর ভেতরে গালার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বাবার সঙ্গে দালির সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

…………………………….…………………………….

সালভাদর দালির উদ্দেশে গীতিকবিতা

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

উঁচু বাগানে আকুল হয়ে একটি গোলাপ চেয়েছিলে তুমি।
ইস্পাতের বিশুদ্ধ ব্যাকরণে একটি চাকা।
ইমপ্রেশনিস্ট কুয়াশার চাদর খোলা উদোম এক পর্বত,
ধূসরেরা দেখছিল সর্বশেষ সুচালো স্তম্ভশ্রেণির ওপর দিয়ে।

আধুনিক চিত্রশিল্পীগণ তাদের সফেদ চিত্রশালায়
চৌকো শেকড়ের বন্ধ্যকৃত ফুল এঁটে নেন।
সেইন নদীর পানিতে একটি মার্বেল বরফচাঁই শীতে কাঁপিয়ে
দেয় জানালাগুলোকে আর ছুড়ে দেয় আইভি লতাগুলোকে।

খোয়া বিছানো পথের ওপর দিয়ে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যায় মানুষ।
প্রতিফলনের জাদু থেকে লুকিয়ে পড়ে স্ফটিকগুলো।
সরকার সুগন্ধির দোকানগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
যন্ত্রটা অবিরাম তার দ্বিঘাত চালিয়ে যায়।

বনের ও পর্দার ও ভুরুর অনুপস্থিতি পুরনো
বাড়িগুলোর ছাদজুড়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সমুদ্দুরে বাতাস তার প্রিজমটাকে চকচকে করে নেয়
এবং দিগন্ত উঠে আসে বিশাল এক জলাধারের মতো।

যে সৈন্যরা কোনো মদ চেনে না এবং গ্রহণ লাগা ছায়া
চেনে না, সমুদ্র-দানবীদের শিরোচ্ছেদ করে সিসার সমুদ্রে।
রাত, দূরদর্শিতার কৃষ্ণমূর্তি, চাঁদের গোল
আয়নাকে ধরে রাখে তার হাতে।

মূর্ততার আকাক্সক্ষা ও সীমাবদ্ধতা আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে।
ঐ সে লোকটি আসে, যে এক হলুদ রুলার দিয়ে দেখে।
ভেনাস এক স্থির সাদা জীবন
এবং প্রজাপতি সংগ্রাহকরা পালিয়ে যায়।

ক্যাডাকুয়েস, জল ও পাহারের অবলম্বনে,
উত্থিত করে সোপানশ্রেণি এবং লুকায় সাগরঝিনুক।
কাঠের বাঁশিগুলো প্রশান্ত করে বাতাস।
এক প্রাচীন বনভূমি দেবতা ফল দেয় শিশুদের।

তার জেলেরা বালুর ওপর ঘুমায় স্বপ্নহীন।
বিস্তৃত সমুদ্দুরে তাদের কম্পাস একটি গোলাপ।
দিগন্ত, আহত রুমালগুলোর কুমারী,
গেঁথে দেয় মাছ ও চাঁদের বিশাল স্ফটিককে ।

শ্বেত দস্যুর এক শক্ত রাজকীয় মুকুট
ঘিরে রাখে বালুর বেদনার্ত ললাট এবং কেশ।
সমুদ্র-দানবী দৃঢ় প্রত্যয়ী করে, তবু তারা প্রতারিত হয় না,
এবং আমরা এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি দেখালেই তারা চলে আসে।

ওহ্ সালভাদর দালি, জলপাই রঙের কণ্ঠস্বর!
আমি তোমার কৈশোরপ্রাপ্ত তুলির থেমে যাওয়ার প্রশংসা করি না
বা তোমার সময়ের রঙে নির্দ্বিধায় মিশে যাওয়া তোমার রঙকে,
তবু সীমার মাঝে অমরত্ব লাভের আকুল আকাক্সক্ষার গুণকীর্তন করি।

স্বাস্থ্যবর্ধক আত্মা, তুমি বাস কর নতুন মার্বেলের ওপর।
অসম্ভব অবয়বের অন্ধকার অরণ্য থেকে দৌড়ে যাও
তোমার কল্পনা পৌঁছে কেবল তোমার হাত অবধি,
এবং তুমি তোমার জানালায় সমুদ্দুরের সনেট উপভোগ কর।

দুনিয়াটা একঘেয়ে উপচ্ছায়া এবং চিত্রের নিকটদৃশ্যে
অরাজকতা, যেখানে মানুষ পাওয়া যায়।
কিন্তু এখন তারারা, প্রাকৃতিক দৃশ্যকে আড়াল করে,
প্রকাশ করে তাদের গতিপথের সঠিক ছককাটা নকশা।

সময়-স্রোতে উপাদান কুড়ায় এবং বিন্যস্ত হয়
শতক শতক ধরে সীমিত হয়ে পড়া আকৃতিতে
এবং যিশুর জয় করা মৃত্যু কেঁপে কেঁপে আশ্রয় নেয়
তাৎক্ষণিক বর্তমানের আঁটো বৃত্তে।

তুমি যখন পাখায় ছিদ্রওলা তোমার রঙ মেশানোর পাত্রটা তুলে নাও,
তখন সে আলোকেই আমন্ত্রণ কর, যা জলপাই গাছকে জীবন ফিরিয়ে দেয়।
মিনার্ভার স্পষ্ট আলো, ফাঁসির মঞ্চের নির্মাতা,
যেখানে স্বপ্নের কোনো ঠাঁই নেই বা এর ঝাপসা ফুলের।

তুমি সেই পুরনো আলোকে আমন্ত্রণ কর যা ভুরুতে থেকে যায়,
মানুষের মুখ বা হৃদয় অবধি নেমে আসে না।
মাইকেলেঞ্জোলোর চিত্রকর্ম বাকহাসের প্রেমময় দ্রাক্ষালতা
এবং বাঁকা জলের বেয়াড়া শক্তিকে ভয় পাওয়া একটি আলো।

তুমি তখনই ভালো কর যখন অন্ধকার সীমানা জুড়ে
সতর্কতার পতাকা গেড়ে দাও, যা রাতে আলো ছড়ায়।
একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে, এক অপ্রত্যাশিত মেঘের স্থান পরিবর্তনশীল
তুলোতে তোমার ফর্ম কোমল করে তুলতে তুমি অস্বীকার কর।

মাছের বাটিতে মাছ এবং খাঁচার পাখি।
তুমি তাদের সমুদ্রে বা বাতাসে আবিষ্কার করতে অস্বীকৃতি জানাও।
একবার তুমি তোমার সততার চোখ দিয়ে তাদের ছোট,
চটপটে দেহ দেখলে অস্বাভাবিক ছবি আঁকতে বা কপি করতে।

তুমি ভালবাস এমন বস্তু যার রয়েছে স্পষ্ট সীমা এবং যা সঠিক,
যেখানে ব্যাঙের ছাতা তাঁবুর খুঁটি গাড়তে পারে না।
তুমি সেই স্থাপত্যকে ভালবাস, যা গড়ে ওঠে আনমনা
এবং স্রেফ মজাচ্ছলে পতাকাটাকে মেনে নাও।

ইস্পাতের কম্পাসটা তার সংক্ষিপ্ত, স্থিতিস্থাপক পদ্য বলে।
নভোম-লের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে উঠে আসে অচেনা মেঘেরা।
সরলরেখা তার ঊর্ধ্বমুখী কঠিন লড়াইয়ের কথা বলে
এবং শিখে নেয়া স্ফটিকগুলো তাদের জ্যামিতির গান গায়।

কিন্তু বাগানের গোলাপটাও, যেখানে তুমি বাস কর।
সব সময়ই গোলাপটা, স-ব সময়, আমাদের উত্তর ও দক্ষিণ!
চোখহীন মূর্তির মতো শান্ত ও সংগৃহীত,
জানে না সমাহিত কঠিন লড়াইকে এটি উসকে দেয়।

খাঁটি গোলাপ, চাতুরী এবং রুক্ষ স্কেচহীন,
আমাদের জন্য হাসির সরু পাখা খুলে দেয়।
(পিনআঁটা প্রজাপতি, যা তার উড়ালের কথা ভাবে।)
ভারসাম্যের গোলাপ, স্ব-আরোপিত বেদনাবিহীন।
সব সময়ই গোলাপটা!

ওহ্ সালভাদর দালি, জলপাই রঙের কণ্ঠস্বর!
তোমার ব্যক্তিত্ব এবং তোমার চিত্রকর্ম আমাকে যা বলে আমি তাই বলি।
আমি তোমার কৈশোরপ্রাপ্ত তুলির থেমে যাওয়ার প্রশংসা করি না,
কিন্তু তোমার তীরের দৃঢ় লক্ষ্যস্থিরের গান গাই।

আমি তোমার ক্যাটালান আলোর সুন্দর লড়াইয়ের গান গাই,
হয়তো যা স্পষ্ট করা যায় তার জন্য তোমার ভালবাসা।
আমি তোমার জ্যোতির্বিদ ও কোমল হৃদয়ের গান গাই,
কখনো আঘাত না পাওয়া ফরাসী কার্ডের এক আচ্ছাদন।

মূর্তির জন্য তোমার নিরলস আকুল আকাক্সক্ষার গান গাই আমি,
তোমাকে যা রাস্তায় অপেক্ষমাণ রাখে তার জন্য তোমার ভয়ের অনুভূতি।
আমি জেগে ওঠা ছোট সমুদ্দুরের গান গাই, যা তোমাকে গান শোনায়,
তার প্রবাল ও শঙ্খের বাইসাইকেলে চড়ে।

কিন্তু সবার ওপরে আমি এক সাধারণ ভাবনার গান গাই
যা আমাদের অন্ধকারে এবং সোনালি সময়ে একত্রিত করে।
যে আলো আমাদের চোখকে অন্ধ করে দেয় তা শিল্প নয়।
এটি বরং ভালবাসা, বন্ধুত্ব, দুই আড়াআড়ি তলোয়ার।

ধৈর্যের সঙ্গে তুমি যে ছবিটি আঁকো তা নয়,
বরং থেরেসার বুক, ঘুমহীন ত্বকের সে,
অকৃতজ্ঞ মাথিলডির ঘন সন্নিবিশিত কোঁকড়া চুল নয়,
আমাদের বন্ধুত্ব, গেম বোর্ডের মতো উজ্জ্বল রঙে আঁকা।

হয়তো সোনার ওপরে রক্তের আঙুলের ছাপ
আঁকাবাঁকা ডোরাকাটা দাগে আঁকা শাশ্বত ক্যাটালুনয়ার হৃদয়
হয়তো তারারা তোমায় প্রতিভাত শ্যেনহীন মুষ্টি পছন্দ করে,
যখন তোমার চিত্রকর্ম ও জীবন ফুলের ভেতরে ঢুকে যায়।

ঝিল্লিযুক্ত পাখার জলঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকো না
বা রূপকের কঠোর কাস্তের দিকে।
সব সময়েই বাতাসে, তোমার তুলিকে পোশাক পরাও এবং খুলে নাও
নাবিক আর জাহাজে সমুদ্রটা ভরে ওঠার আগেই।

…………………………….…………………………….

দালি ও গালার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে দালির বাবা ডন সালভাদর দালি ওয়াই কুসি ভীষণ রেগে যান। তার আইনজীবী বাবা আরো লক্ষ করলেন যে স্যুরিয়ালিস্টদের সঙ্গে মিশে তার ছেলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার রাগের আগুনে চূড়ান্ত ঘি ঢেলে দেয় বার্সেলোনার একটি খবরের কাগজে প্রকাশিত প্যারিসে প্রদর্শিত দালির ‘সিকরেট হার্ট অব জেসাস’ শিরোনামে চিত্রকর্মবিষয়ক খবর। তিনি দালিকে চিত্রকর্মটি প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। এমনটি করলে স্যুরিয়ালিস্টিক গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করা হতে পারেÑ এই ভয়ে দালি তার বাবার নির্দেশ অগ্রাহ্য করেন। এতে ১৯২৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর দালিকে নির্দয়ভাবে তার পৈতৃক বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, তার বাবা তাকে সাফ জানিয়ে দেন, তাকে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে এবং দালি যেন ক্যাডাকুইসে আর পা না রাখেন। পরের বছর গ্রীষ্মে পোর্ট ল্লিগাটের কাছে দালি ও গালা একটি জেলেবাড়ি ভাড়া নেন। পরে দালি জায়গাটা কিনে নেন এবং কয়েক বছরেই সমুদ্রতীরে তার খুবই প্রিয় বাড়িটি নির্মাণ করেন। শেষমেশ দালির বাবা নরম হন এবং ছেলের সঙ্গিনীকে মেনে নেয়ার জন্য সেখানে আসেন।

দালি তার অন্যতম বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ আঁকেন ১৯৩১ সালে। এই চিত্রকর্মে তার স্যুরিয়ালিস্ট ভাবনা বাক্সময় হয়ে ওঠে, যেখানে– দেখা যায় পকেটঘড়িগুলো নরম হয়ে গলে গলে পড়ছে। এটির সাধারণ ব্যাখ্যা হচ্ছে : নরম হয়ে গলে যাওয়া ঘড়িগুলো হচ্ছে– সময় যে অদম্য বা সব ঘটনাই মানুষের ইচ্ছেবহির্ভূত কোনো-না-কোনো নিমিত্ত হতে উদ্ভূত– এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করার রূপক।

‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ 
দালি ও গালা ১৯৩১ সাল থেকেই একসঙ্গে থাকছিলেন। ১৯৩৪ সালে আধাআধি গোপনভাবে তারা বিয়ে-বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে ১৯৫৮ সালে ক্যাথলিক রীতিতে তারা আবার বিয়ে করেন। বয়সে বড় গালা শুধু দালির পরম বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গিনীই ছিলেন না, তার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বও পালন করেন।

১৯৮৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দালি হাসপাতালে ভর্তি হন। অবশ্য এর আগেই তিনি এ সমস্যায় ভুগছিলেন এবং তার হৃৎপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়েছিল। সে বছরের ৫ ডিসেম্বর রাজা জুয়ান কার্লোস তাকে দেখতে হাসপাতালে যান এবং স্বীকার করেনÑ তিনি দালির একান্ত অনুরক্ত। ১৯৮৯ সালের ২৩ জানুয়ারি এই মহান শিল্পী হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

এদিকে ১৯২৫ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত একে অন্যের প্রতি মোহাবিষ্ট থেকে বিশ্বকে এক সৃষ্টিশীল শৈল্পিক বন্ধুত্ব উপহার দেয়ার পর দালির সঙ্গে লোরকার সম্পর্কের ইতি ঘটে। এ সময়ে ‘জিপসি ব্যালাড’ কাব্যগ্রন্থটি লোরকাকে যেমন খুব খ্যাতি এনে দিয়েছিল তেমনি দালি তার সমকামী আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেলে এবং ভাস্কর এমিলিও সোরিয়ানোর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক চুকে গেলে লোরকা ভেতরে ভেতরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তিনি তার নিজস্ব সমকামিতার ওপর তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েন। বিপর্যস্ত লোরকার মনে হতে থাকে, একজন সফল কবি-নাট্যকারের ব্যক্তিত্ব, যা তাকে প্রকাশ্যে বজায় রাখতে হয় এবং তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট খাঁটি সত্তার মাঝে ফাটা বাঁশে মাছ আটকানোর মতো এক ফাঁদে আটকা পড়েছেন তিনি। এও মনে হতে থাকে, একজন জিপসি কবি হিসেবে তিনি একটি পায়রার খোপে আটকা পড়েছেন। তার নিজের বয়ানেই শোনা যাক অবস্থাটা– ‘জিপসিরা হচ্ছে কবিতার একটি বিষয়বস্তু, তা ছাড়া আর কিচ্ছুটি নয়। আমি স্রেফ সেলাইয়ের সুই বা প্রবহমান জলীয় দৃশ্যপটের কবিও হতে পারতাম। আর তা ছাড়া এই জিপসিজম বা ভবঘুরেবাদিতা আমাকে একটি অসভ্য, অশিক্ষিত ও আদিম কবি চেহারা দিয়েছে এবং আপনারা বেশ ভালো করেই জানেন আমি তা নই। আমি টাইপকাস্ট বা গণ্ডিবদ্ধ হতে চাই না।’ লোরকার সঙ্গে তার বন্ধুদের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অধ্যায়টা চরম রূপ নেয় যখন ১৯২৯ সালে স্যুরিয়ালিস্ট দালি ও লুইস বুনুয়েল যৌথভাবে ‘উন চিয়েন আন্দালু’ ( অ্যান আন্দালুশিয়ান ডগ) নামের স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবিটি নির্মাণ করেন। লোরকার মনে হতে থাকে তাকে ভীষণ এক আঘাত দিতেই ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে।

গার্সিয়া লোরকার পরিবার এইসব সমস্যা থেকে রেহাই দিতে লোরকাকে ১৯২৯-৩০ সালে এক লম্বা সফরে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়। ১৯২৯ সালের জুন মাসে ফার্নান্দো ডি লস রিয়োসের সঙ্গে লোরকা টাইটানিকের সিস্টার শিপ এসএস অলিম্পিক জাহাজে চেপে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। রিয়োস লেকচার ট্যুরে ব্যস্ত থাকেন আর লোরকা বাবা-মায়ের খরচে কলাম্বিয়া স্কুল অব জেনারেল স্টাডিসে ভর্তি হন। সেখানে তার বিষয় ছিল আগের মতোই ইংরেজি। কিন্তু ক্লাসের পড়াশোনার চেয়ে তিনি লেখালেখিতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। ভারমন্ট এবং পরে কিউবাতেও সময় কাটান। এ সময়ে তার লেখা কবিতাগুলো নিয়ে তার মৃত্যুর পর ১৯৪২ সালে ‘পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক’ ( নিউইয়র্কে একজন কবি) নামের কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, যাতে ফুটে ওঠে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও নিঃসঙ্গতা। এ কবিতাগুলোতে ওয়াল স্ট্রিটে তার ব্যক্তিগত অজ্ঞিতার সঙ্গে নীরিক্ষাধর্মী কাব্য-কুশলতা যোগ হয়ে এক এক ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। এই শহুরে ধনবাদী সমাজের নিন্দা এবং কাব্যে বাস্তবানুগ আধুনিকতার প্রয়োগ তার আগের সাহিত্যকর্মের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। এ সময়ে তাকে লোক-সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। তখন তিনি ‘এল পুবলিকো’ (দ্য পাবলিক) নামের যে নাটকটি লেখেন তা ১৯৭০ সালের আগে প্রকাশিত হয়নি এবং পুরো নাটকটি কখনোই প্রকাশিত হয়নি।

ঘটনাক্রমে ১৯৩০ সালে লোরকা যখন স্পেনে ফিরে আসেন তখনই প্রাইমো ডি রিভেরার একনায়কতন্ত্রের পতন হয় এবং স্প্যানিশ রিপাবলিক পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩১ সালে তাকে ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট থিয়েটারের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তহবিলে পরিচালিত এ থিয়েটারের দায়িত্ব ছিল স্পেনের প্রত্যন্ত এলাকায় আধুনিক নাট্যমঞ্চ গড়ে তোলা। বহনযোগ্য মঞ্চ এবং অল্প কিছু উপকরণ নিয়ে তারা জনসাধারণকে এমন সব নাটক দেখিয়ে বেড়ান, যা তারা আগে কখনো দেখেননি। লোরকা এ সময় নাটক পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও করতেন।

লোরকা তার জীবনের শেষদিকে কবিতা লিখেছেন খুবই কম। ১৯৩৬ সালে এ ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলেন, ‘নাটক হচ্ছে গ্রন্থ থেকে উৎসারিত কবিতা এবং কথা ও চিৎকারে তা মানবিক হয়ে ওঠে।’

নাটকের ধ্রুপদী শেকড় সন্ধানে প্রত্যাবর্তনের পাশাপাশি শেষ জীবনে লোরকা কবিতারও প্রথাগত ফর্মে ফেরেন। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত লোরকা গ্রানাডায় হুয়ের্তা ডি সান ভিসেনটিকে নিজের বাসবভন হিসেবে ব্যবহার করেন। এখানেই তিনি তার ‘হোয়েন ফাইভ ইয়ার্স পাস’ (১৯৩১), ‘ব্লাড ওয়েডিং’ (১৯৩২), ‘ইয়ারমা’ (১৯৩৪) এবং ‘ডিভান দেল তামারিতে’র (১৯৩১-১৯৩৬) মতো বিখ্যাত গ্রন্থগুলো রচনা করেন।

১৯৩৬ সালের জুলাইয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরুর তিনদিন আগে তিনি মাদ্রিদ থেকে গ্রানাডায় পারিবারিক বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। রিপাবলিকান অ্যাসাল্ট গার্ডস প্রখ্যাত রাজতন্ত্রবাদী এবং পপুলার ফ্রন্টবিরোধী হোসে কালভো সোতেলোকে হত্যা করলে স্পেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। লোরকা জানতেন, উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে উদীয়মান উগ্র ডানপন্থীরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখবে। ১৮ অগাস্ট তার ভগ্নিপতি, গ্রানাদার বামপন্থী মেয়র মানুয়েল ফের্নান্দেস-মন্তেসিনোসকে গুলি করে মারা হয়। ধারণা করা হয়, এর পরদিন, ১৯৩৬ সালের ১৯ অগাস্ট জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়ারা লোরকাকে গুলি করে হত্যা করে।

সালভাদর দালি ও গার্সিয়া লোরকার বিখ্যাত শৈল্পিক বন্ধুত্ব শুধু স্পেন নয়, পুরো বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যকেই ঋদ্ধ করেছে অনেক দিক দিয়ে। লোরকা তার শিল্পীবন্ধু দালিকে নিয়ে যে বিখ্যাত গীতিকবিতাটি লিখেছিলেন তাতেই প্রমাণ মেলে কতটা গভীর ছিল তাদের সম্পর্ক।

No comments:

Post a Comment