পত্র সাহিত্য
তারিখ ---: সাতই পৌষ মাস 1972 পুন লিখন তারিখ--- 20 -- 4 -- 17
লাবণ্য আকতারকে খোলা চিঠি
শ্যামল সোম
লাবণ্য উনিশো বাহাত্তর সালে কোন বৃষ্টি ঝরা শীতে দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের অত্যাধুনিক আজও
রোমান্টিক উপন্যাস ঐতিহাসিক শাশ্বত সুন্দর সত্য বিখ্যাত উপন্যাস " শেষে কবিতা " পড়ছিলাম দুজনে এক সাথে
কখন তুমি পড়ছো ক্লান্ত হলে বিশ্রাম চা কফি কখন পেস্তা বাদামের সরবত কাবাব টিকিয়া মুখ চলছে।
তুমি প্রেমাচ্ছন্ন চোখে পড়তে শুরু করতেই ঝাঁপিয়ে নামলো বৃষ্টি ।
ঢাকার বিখ্যাত কাঁথা সেলাই করা বালাপোষ খানা গানে ভালো করে জরিপে নিয়েই লাবণ্য তোমার দিকে তাকিয়ে শুনছি বৃষ্টি মতন সুমধুর স্বরে সুরে শেষের কবিতা পড়ছো।
( " সেদিন পিকনিকে গঙ্গার ধারে যখন ও পারের ঘন কালো পুঞ্জীভূত স-ব্ধতার উপরে চাঁদ উঠল, ওর পাশে ছিল লিলি গাঙ্গুলি। তাকে ও মৃদুস-রে বললে, “গঙ্গার ও পারে ঐ নতুন চাঁদ, আর এ পারে তুমি আর আমি, এমন সমাবেশটি অনন-কালের মধ্যে কোনাদিনই আর হবে না”।
প্রথমটা লিলি গাঙ্গুলির মন এক মুহূর্তে ছল্ছলিয়ে উঠেছিল; কিন্তু সে জানত, এ কথাটায় যতখানি সত্য সে কেবল ঐ বলার কায়দাটুকুর মধ্যেই। তার বেশি দাবি করতে গেলে বুদবুদের উপরকার বর্নচ্ছটাকে দাবি করা হয়। তাই নিজেকে ক্ষণকালের ঘোর-লাগা থেকে ঠেলা দিয়ে লিলি হেসে উঠল, বললে, “অমিট, তুমি যা বললে সেটা এত বেশি সত্য যে, না বললেও চলত। এই মাত্র যে ব্যাঙটা টপ করে জলে লাফিয়ে পড়ল এটাও তো অনন-কালের মধ্যে আর কোনাদিন ঘটবে না”।
অমিত হেসে উঠে বললে, “তফাত আছে, একেবারে অসীম তফাত। আজকের সন্ধ্যাবেলায় ঐ ব্যাঙের লাফানোটা একটা খাপছাড়া ছেঁড়া জিনিস। কিন্তু তোমাতে আমাতে চাঁদেতে, গঙ্গার ধারায়, আকাশের তারায়, একটা সম্পূর্ণ ঐকতানিক সৃষ্টি–বেটোফেনের চন্দ্রালোক-গীতিকা। আমার মনে হয় যেন বিশ্বকর্মার কারখানায় একটা পাগলা স্বর্গীয় স্যাকরা আছে; সে যেমনি একটি নিখুঁত সুগোল সোনার চক্রে নীলার সঙ্গে হীরে এবং হীরের সঙ্গে পান্না লাগিয়ে এক প্রহরের আঙটি সম্পূর্ণ করলে আমনি দিলে সেটা সমুদ্রের জলে ফেলে, আর তাকে খুঁজে পাবে না কেউ”।
“ভালোই হল, তোমার ভাবনা রইল না, অমিট, বিশ্বকর্মার স্যাকরার বিল তোমাকে শুধতে হবে না”। “কিন্তু লিল, কোটি কোটি যুগের পর যদি দৈবাৎ তোমাতে আমাতে মঙ্গলগ্রহের লাল অরন্যের ছায়ায় তার কোনো-একটা হাজার-ক্রোশী খালের ধারে মুখোমুখি দেকা হয়, আর যদি শকুন-লার সেই জেলেটা বোয়াল মাছের পেট চিরে আজকের এই অপরূপ সোনার মূহূর্তটিকে আমাদের সামনে এনে ধরে, চমকে উঠে মুখ-চাওয়া-চাউয়ি করব, তার পরে কী হবে ভেবে দেখো”।
লিলি অমিতকে পাখার বাড়ি তাড়না করে বললে, “তার পরে সোনার মুহূর্তটি অন্যমনে খসে পড়বে সমুদ্রের জলে। আর তাকে পাওয়া যাবে না। পাগলা স্যাকরার গড়া এমন তোমার কত মূহুূর্ত খসে পড়ে গেছে, ভুলে গেছ বলে তার হিসেব নেই”।
এই বলে লিলি তাড়াতাড়ি উঠে তার সখীদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিলে। অনেক ঘটনার মধ্যে এই একটা ঘটনার নমুনা দেওয়া গেল।
অমিতর বোন সিসি-লিসিরা ওকে বলে, “আমি তুমি বিয়ে কর না কেন?” অমিত বলে, “বিয়ে ব্যাপারটায় সকলের চেয়ে জরুরি হচ্ছে পাত্রী, তার নীচেই পাত্র”। সিসি বলে, “অবাক করলে, মেয়ে এত আছে”।
অমিত বলে, “মেয়ে বিয়ে করত সেই পুরাকালে লক্ষণ মিলিয়ে। আমি চাই পাত্রী আপন পরিচয়েই যার পরিচয়, জগতে যে অদ্বিতীয়।”
সি সি বলে, “তোমার ঘরে এলেই তুমি হবে প্রথম, সে হবে দ্বিতীয়, তোমার পরিচয়েই হবে তার পরিচয়”। অমিত বলে, “আমি মনে মনে যে মেয়ের ব্যর্থ প্রত্যাশায় ঘটকালি করি সে গরঠিকানা মেয়ে। প্রায়ই সে ঘর পর্যন- এসে পৌঁছয় না। সে আকাশ থেকে পড়ন- তারা, হৃদয়ের বায়ুমন্ডল ছুঁতে-না-ছুঁতেই জ্বলে ওঠে, বাতাসে যায় মিলিয়ে, বাস’ঘরের মাটি পর্যন- আসা ঘটেই ওঠে না।”
সিসি বলে, “অর্থাৎ সে তোমার বোনেদের মতো একটুও না”।
অমিত বলে, “অর্থাৎ, সে ঘরে এসে কেবল ঘরের লোকেরই সংখ্যা বৃদ্ধি করে না।”
লিসি বলে, “আচ্ছা ভাই সিসি, বিমি বোস তো অমির জন্যে পথ চেয়ে তাকিয়ে আছে, ইশারা করলেই ছুটে এসে পড়ে, তাকে ওর পছন্দ নয় কেন? বলে, তার কালচার নেই। কেন ভাই, সে তো এম,এ-তে বটানিতে ফারস্ট্। বিদ্যেকেই তো বলে কালচার।”
অমিত বলে, “কমল-হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি।” ")
লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে -- " শ্যামল কি আশ্চর্য ব্যাপার কত প্রাসঙ্গিক সমাজের বুদ্ধিমান মানুষ মানুষের জন্য অবশ্য পাঠ্য কিন্তু অদ্ভুত শেষের কবিতা না পড়ে
আবোল তাবোল শতসহস্র কোটি কোটি কবি লিখছে আবার ছাপাচ্ছে যা অপচয়, ---- "
আমি হাসতে হাসতে বলি ---" তবু বাংলা ভাষার চর্চা করেন এরা সবাইকে আমি কুর্নিশ জানাই -- "
" সালাম বল " হোহো করে ঝর্নার মতন হেসে লাবণ্য আকতার।
আমি গলায় মাধুর্যের মধু ঢেলে লাবণ্য কে শেষের কবিতা পাঠ করছি ---
( "" সভাপতি উঠে বললে, ‘কবিমাত্রের উচিত পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন-। এ কথা বলব না যে পরবর্তীদের কাছ থেকে আরো ভালো কিছু চাই, বলব অন্য কিছু চাই। ফজলি আম ফুরালে বলব না, আনো ফজরিতর আম; বলব, নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে। ডাব-নারকেলের মেয়াদ অল্প, সে রসের মেয়াদ; ঝুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি; সে শাঁসের মেয়াদ। কবিরা হল ক্ষণজীবী, ফিলজফরের বয়সের গাছপাথর নেই।… রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো নালিশ এই যে,বুড়ো ওয়ার্ডস্বার্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়রকম বেঁচে আছে। যম বাতি নিবিয়ে দেবার জন্যে থেকে থেকে ফরাশ পাঠায়, তবু লোকটা দাাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চৌকির হাতা আঁকড়িয়ে থাকে। ও যদি মানে মানে নিজেই সরে না পড়ে, আমাদের কর্তব্য ওর সভা ছেড়ে দল বেঁধে উঠে আসা। পরবর্তী যিনি আসবেন তিনিও তাল ঠুকেই গর্জাতে গর্জাতে আসবেন যে, তাঁর রাজত্বের অবসান নেই, অমরা বর্তী বাঁধা থাকবে মর্তে তাঁরই দরজায়। কিছুকাল ভক্তরা দেবে মাল্যচন্দন, খাওয়াবে পেট ভরিয়ে, সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করবে, তার পরে আসবে তাঁকে বলি দেবার পুন্যদিন-ভক্তিবন্ধন থেকে ভক্তদের পরিত্রাণের শুভলগ্ন। আফ্রিকার চতুষ্পদ দেবতার পুজোর প্রনালী এই রকমই। দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদী চতুর্দশপদী দেবতাদের পুজোও এই নিয়মে। পূজা জিনিসটাকে একঘেয়ে করে তোলার মতো অপবিত্র অধার্মিকতা আর- কিছু হতে পারে না। … ভালো-লাগার এভোল্যুশন আছে। পাঁচ বছর পূর্বেকার ভালো-লাগা পাঁচ বছর পরেও যদি এই জায়গায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে, বেচারা জানতে পারে নি যে সে মরে গেছে। একটু ঠেলা মারলেই তার নিজের কাছে প্রমাণ হবে যে, সেন্টিমেন্টাল আত্মীয়েরা তার অনে-্যষ্টি- সৎকার করতে বিলম্ব করেছিল, বোধ করি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে চিরকাল ফাঁকি দেবার মতলবে। রবি ঠাকুরের দলের এই অবৈধ ষড়যন্ত্র আমি পাবলিকের কাছে প্রকাশ করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছি।’ )
শেষের কবিতার উপন্যাসের অমিতে লেখা বলাবাহুল্য এ কবিতাও রবীন্দ্রনাথের এই রবীন্দ্রনাথ জন্য লাবণ্য ও আমার বন্ধুত্বের কাছাকাছি এসেছিলাম।
আনিলাম
অপরিচিতের নাম
ধরনীতে,
পরিচিত জনতার সরনীতে।
আমি আগনত্তক,
আমি জনগণেশের প্রচন্ড কৌতুক।
খোলো দ্বার,
বার্তা আনিয়াছি বিধাতার।
মহাকালেম্বর
পাঠায়েছে দুর্লক্ষ্য অক্ষর,
বল্ দুৎসাহসী কে কে
মৃত্যু পণ রেখে
দিবি তার দুরূহ উত্তর।
শুনিবে না।
মুঢ়তার সেনা
করে পথরোধ।
ব্যর্ত ক্রোধ
হুংকারিয়া পড়ে বুকে-
তরঙ্গের নিষ্ফলতা
নিত্য যথা
মরে মাথা ঠুকে
শৈলতট-পরে
আত্মঘাতী দম্ভভরে।
পুষ্পমাল্য নাহি মোর, রিক্ত বক্ষতল,
নাহি বর্ম অঙ্গদ কুন্ডল।
শূন্য এ ললাটপটে লিখা
গুঢ় জয়টিকা।
ছিন্নকস’া দরিদ্রের বেশ। ???
করিব নিঃশেষ
তোমার ভান্ডার।
খোলা খোলা দ্বার।
অকস্মাৎ
বাড়ায়েছি হাত,
যা দিবার দাও অচিরাৎ!
বক্ষ তব কেঁপে ওঠে, কম্পিত অর্গল,
পৃথ্বী টলমল।
ভয়ে আর্ত উঠিছে চীৎকারি
দিগন- বিদারি-
‘ফিরে যা এখনি,
রে দুর্দান- দুরন- ভিখারি,
তোর কন্ঠধ্বনি
ঘুরি ঘুরি
নিশীথনিদ্রার বক্ষে হানে তীব্র ছুরি।’
অস্ত্র আনো।
ঝঞ্চ্র নিয়া আমার পঞ্জরে হানো।
মৃত্যুরে মারুক মৃত্যু, অক্ষয় এ প্রাণ
করি যাব দান।
শৃঙ্খল জড়াও তবে,
বাঁধো মোরে, খন্ড খন্ড হবে
মুহূর্তে চকিতে-
মুক্তি তব আমারি মুক্তিতে।
শাস্ত্র আনো।
হানো মোরে, হানো।
পন্ডিতে পন্ডিতে
ঊর্ধ্ব স্বরে চাহিবে খন্ডিতে
দিব্য বানী।
জানি জানি,
তর্কবাণ
হয়ে যাবে খান-খান।
মুক্ত হবে জীর্ণ বাক্যে আচ্ছন্ন দু চোখ,
হেরিবে আলোক।
অগ্নি জ্বালো।
No comments:
Post a Comment