Sunday, 17 September 2017

জীবন যখন যেমন

জীবন যখন যেমন

শ্যামল  সোম

জীবন যখন যেমন, আত্মজীবনী মূলক লেখা, আমি শুনেছি পড়েছি যা নিজের চোখে দেখেছি,  আমায়,  দুঃখ, হতাশা,  ক্রোধ,  বিস্মিত, কখন আনন্দিতা, করেছে, সাথে আমাকে পরিচালনা করছেন তিনি,  রক্ষা করছেন, তাঁর কৃপা,  তাঁর সাথে প্রেমের সম্পর্ক আমার,  জীবন যখন যেমন -সহজেই নিয়েছি মানিয়া।

শৈশবের স্মৃতি

শৈশবের স্মৃতি রোমন্থনে প্রথমে মনে আসে, ভ্রমন।হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছলাম ঘোড়ার গাড়িতে দাদুর বাড়ির কাজের লোক বিশুদা বাক্স ঝোলা ঝুলি নামাচ্ছে, দিদার, হাত আঁকড়ে ধরে, অবাক বিস্ময়ে চোখে স্টেশনে ব্যস্ততা লোকজনের ছোটাছুটি, কুলিদের হাঁকাহাঁকি, ঘন ঘন গা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে উত্তেজনায় এই বুঝি রেলগাড়ি দেয় ছেছেড়ে, প্রচন্ড শব্দে বারবার বাজছে হুইসেল। দাদু কুলির মাথায় বেডিং, বাক্স, চাপিয়ে, ধূতির-ধূতির-কোঁচা ধরে ছড়ি হাতে হেলতে দুলতে আসছেন, পেছনে বিশুদার, মাথায় বোঁচকা, হাতে ঝোলা।
    নামাবলী  ঝুলি, দিদা গলায় ঝুলিয়ে হাত আমার টানতে টানতে
নির্দিষ্ট রেলগাড়ি র কামরার কাছে আনলেন।
তখন  আমি বছর পাঁচেক 1950 সাল দূরগা পূজার ছুটি স্কুলে, দাদানের বড় আদরের নাতি, আমার পরনে শেরওয়ানি, পা নাকড়া।
সব জিনিস পত্তর গুছিয়ে রেখেছে বিশুদা, কামরার জানলার ধারে বসে দেখছি কত লোকে কত জায়গায় যাওয়ার জন্য অনেকই, নানা ধান্ধায়, ভ্রমনে বেড়িয়েছে। প্রতি বছরই দাদু তীর্থ ভ্রমনে বেড়োন।
আমরা চলেছি, কাশী, মহা মহেশ্বর দ্বাদশ জ্যোতি লিঙ্গ শিব
যিনি শব হয়ে শুয়ে আছেন প্রকৃতি মহামায়ার পদ তলে।
তীর্থে চলেছি মহা বিশ্বেশ্বর শিব দর্শনে।
অনেকই চলেছেন নানা তীর্থে, সাধু সঙ্গে, সৎ ভক্ত   ভক্তের সাথে মহা মিলন, মৃত্যু, রোগের প্রকোপে ওষ্ঠাগত প্রানে,  মনের শান্তির খোঁজে
- ঈশ্বরের সন্ধানে,  দেব দর্শনে আশায় --
"  আসার আশা কেবল আসা - আসা মাত্রই সার হল,"
রবীন্দ্র নাথ লিখছেন- রাতের গাড়ি-  "এ প্রান রাতের রেলগাড়ি দিল পাড়ি-- কামরায় গাড়ি ভরা ঘুম,  রজনী নিঝুম।---- অতি দূর তীর্থের যাত্রী, ভাষা হীন রাত্রি-- দূরের কোথা যে শেষ ভাবিয়া না পাই উদ্দেশ।। "
রেলগাড়ি দেয় ছাড়ি, চলে গাছ সারি সারি, মাঠ খেত ছাড়িয়ে, নদী নালা পেরিয়ে, মেঘেদের
সাথে সাথে, ধান কাটে হাতে হাতে। চলে রেল, কু ঝিক ঝিক, ওড়ে ধোঁয়া আকাশে তিক তিক। কয়লা পোড়া গন্ধ ভাসে বাতাসে,। আলো জ্বলে পুকুরের জলে ঝিকমিক; চাঁদ উঠে তারা ফোটে আকাশে। চরৈ বতে চরৈ বতে, চলরে মন চলাই জীবন, যেতে হবে যেতে হবে অনেক দূরে, সেই সে মনের মানুষ আছেন সেথায় অচিন পুরে।
অচিন পুর কোথায় জানি না, কিন্তু কাশী আমার কাছে, হৃদয় পুর।
সেই 1950 সালে কাশীর কেদার ঘাটে কাছে দাদুর বন্ধু তাঁর, শিবধাম বাড়ি থেকে গঙ্গার পার দিয়ে দাদুর হাত ধরে হেঁটে হেঁটে একে বিভিন্ন বিকালে গিয়ে বসতাম। দশাশ্বমেধ ঘাটে কাছে ব্রজেশ্বর শিব দর্শন করে এসে বসে শুনছি হাত জোড় করে, দিদা রুদাক্ষের মালা, জপমালা রেশমের থলিতে হাত নেড়ে জপ করছেন, কথক ঠাকুর বলছেন- "হে রাম তোমায় আমি নৌকা করে পার করে দেব না আগে তোমার চরণ যুগল  পূজো বন্দনা করার জন্য আমাকে কৃপা প্রভু!" আমি অবাক হয়ে ভাবছি,  এখন ভাবি, যিনি পরম ব্রহ্ম, তাকে নদী পার করাচ্ছে কূহক মাঝি। আবার জয় রাম বলে হনুমান এক লাফ দিয়ে লঙ্কায় পৌঁছে গেল, এদিকে শ্রী রামচন্দ্রকে লঙ্কায় যেতে সেতু বাঁধতে হল। এই হচ্ছে অবতারের লীলা। রাবণ বধের পর তার মা নীকষা পালাচ্ছে, ডেকে জিজ্ঞেস করতে, তিনি করজোড়ে- হে রাম তোমার অমর লীলা বাসনা আছে প্রভু।অহল্যা বলছেন, হে রাম তুমি এই বর দাও যেন শুয়োরের গর্ভে জন্মে ও তোমায় না ভুলি।আমি আজ এই জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে, প্রার্থনা করি,  হে প্রাণের ঠাকুর রামকৃষ্ণ, আমার আম্মা যে তোমায় চায়, জন্ম জন্ম যেন পাই তোমাকে। এইটুকুই প্রার্থনা প্রভু, যেন কৃপা কৃপা পাই তোমার।
দুই কাশী মাটিতে বাস করে ছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ, দু-দুবার এসেছিনে। শ্রীমা ঠাকুর নশ্বর দেহ ত্যাগের পর শোকাহতা। বলরাম বসু
মায়ের অনুমতি নিয়ে মায়ের কাশী যাত্রার ব্যাবস্থা করেন। কয়েকবার মায়ের কাশীকাশতে লক্ষী নিবাসে
কালে কালে কত শত সাধক, সাধু এই কাশীর গঙ্গা তীরে বসে সাধনা করে আসছেন। আচার্য শঙ্কর, আদিনাথ, পরম বৈষ্ণব মাধবাননদ -রামানন্দ,  রামানন্দ-রামানুজ বহু সাধকের পুঞ্জিপুঞ্জীভূত সাধনার ফল, সহজেই মনে ধ্যান মগ্ন হয়। দাদাভাই গভীর ধ্যানে, চোখে মুখে জ্যোতি।এই ধ্যান করার পদ্ধতি আমি প্রথম শৈশবে শিখলাম দাদাভাই এর কাছে- নিদিষ্ট আসনে মন স্থির মনে ইষ্ট স্মরণ, শ্বাস প্রশ্বাস এর মন সংযোগ, হৃদয়ে ইষ্ট মূর্তি পদ্মাসনে প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর উপবিষ্ট।দেহের বিভিন্ন চক্রে মন নিবেশ।
যোগনন্দ, শিবানন্দ, বহু আশ্রমে, বিপাসনা কেন্দ্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক বা গুরুর কাছে, প্রাণায়াম শিক্ষা না করলে নয়।

পরম পবিত্র স্থান এই কাশীধাম, স্বয়ং শিব অধিষ্ঠান করছেন।
দাদুভাই--" কাশীবাসের পরে মৃত্যু আমার বন্ধু কাশীনাথের। ঠাকুর বলছেন সে উদ্ধার হয়ে যাবে।" "কী অপরিসীম বিশ্বাস তোমার দাদুভাই" আদর করে বললেন, "ভাই রে ঐ বিশ্বাস সার, বিশ্বাস নিয়ে আছি। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,  তর্কে বহুদূর।বিশ্বাস করলে, তিনিই সাক্ষাৎ নারায়ণ,  নইলে--, একটা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, কী পাথরের নুড়ি?"
বহু ধর্মাবতারের লীলার ক্ষেত্রে এই ভারতবর্ষে। ভীষণ পবিত্র ভূমি, তাই  কুরুক্ষেত্র, প্রয়াগ, প্রভাস, দ্বারকা, অমরনাথ, কেদারনাথ, প্রতিটি তীর্থে  
রজ- পবিত্র মাটি তীর্থ যাত্রী-যাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে ফিরতে। ধন্য এ ধুলায় জন্ম।প্রভু ভালোবেসে ধুলায় আছি পড়ে। তোমায় ভালোবেসে ধর্মের
ইতিহাসে, মানব সভ্যতার ইতিহাসের শিখলাম, হে রুদাক্ষ শিব, নারায়ণ, কালী, রাম আবার কৃষ্ণ- রামকৃষ্ণ।
এক তারাতে বেঁধে নিলেম দোতারার--সুর একই দেহে রাম আর কৃষ্ণ সুমধুর।

No comments:

Post a Comment