Wednesday, 24 May 2017

কবি কাজী নজরুল ইসলাম

আজ কাজী নজরুল ইসলাম পৃথিবীর বুকে উল্কা মতন বিদ্রোহী কবি  এই পূণ্য আবির্ভাব হয়েছিল যিনি আজও  আমাদের সকলের কাছে প্রানের কবি প্রাত স্মরণীয়,
শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।

নজরুল ইসলাম

জীবনী, বাংলাদেশ, সাহিত্য by মুনিম সিদ্দিকী

কবি নজরুলকে ভারতের কবি, বাংগালীর কবি, সাম্যবাদী কবি,মানবতার কবি, বিদ্রোহের কবি যা বিশেষণে ভূষিত করা হয়না কেন তাতে আমার দ্বিমত করা কিছু নয় কিন্তু যদি বলা হয় তিনি ইসলামের কবি, মুসলিম বাংগালীর কবি তাহলে সেখানে আমার দ্বিমত আছে। আর কেন সে দ্বিমত তার ব্যাখ্যায় আমার এই ব্লগটি।
১৮৯৯ সালের ২৪শে মে বাংলা ১৩০৬ সন ১১ই জ্যৈষ্ঠ- মঙ্গলবার জনপ্রিয় কবি নজরুল জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ভারতের পশ্চিম বংগ রাজ্যে্র বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া নামক গ্রামে নিতান্ত গরীব মুসলিম মা বাবার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। বাবা কাজী ফকির আহমদ ও মা জাহেদা খাতুন। তাঁদের ৬ষ্ঠ সন্তান ছিলেন নজরুল। বংশানুক্রমে প্রাপ্ত পূর্বপুরুষ পীরের মাজারের খাদেম আর মসজিদের ইমামতি—এর উপর নির্ভরশীল ফকির আহমদের সংসার। পাঁচবছর বয়সে তার হাতেখড়ি হয়েছিলো গ্রামের মক্তবে। সেখানে আরবি-ফার্সি ভাষা শেখার গোড়াপত্তন হল।
নজরুল মুসলিম মা বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া এবং মুসলিম পরিবেশে বড় হওয়ার কাছে কিশোর বয়সে ঘরে আরবি ফার্সি ভাষায় তালিম নিয়েছিলেন। সেকারণে তাঁর প্রাথমিক জীবনের লেখালেখিতে ধর্মীয় চেতনার বেশ গাঢ় ছাপ পাওয়া যায়। তাঁর প্রথম কবিতা- কোন এক মুসলিম ফকিরের অলৌকিক কাহিনী নিয়ে লেখা হয়েছিল- সে কবিতার একটি অংশ –“ রক্তাক্ত সে চূর্ণ বক্ষে বন্ধ দুটি হাত—থুয়ে ফকির পড়ছে শুধু কোরআনের আয়াত”।
মাত্র আট বছর বয়সে মারা গেলেন পিতা ফকীর আহমদ। দু’বছর পরেই ১০ বছর বয়সে এই কিশোর সংসারের সকল দায়দায়িত্বের অংশ বিশেষ নিজের কাঁধে তুলে নেন। মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরপরই তিনি লেখাপড়ায় বাদ দিয়ে ‘লেটর’ দলে যোগ দেন । বড়ভাই সাহেবজান সামান্য বেতনে একটা চাকরী জুটিয়ে নিয়েছিল কয়লা খনিতে। নজরুল মাজারের খাদেম ও মসজিদের ইমামতি আর লেটর দলের জন্য গান লিখে যে দুচার পয়সা আয় করতেন –দু’ভাইয়ের এই আয় দিয়েই কোনমতে সংসার চলে। এরপর পাড়া প্রতিবেশী নজরুলকে আবার স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেয়। বছর খানেক লেখাপড়ার পর আবার অভাবের কারণে স্কুল ছাড়তে হয়। এবার পেটে জ্বালা নিবারণ করতে রুটি দোকানে শুধু খাবার বিনিময়ে চাকুরী নেন কিন্তু সে দোকানে থাকার ব্যবস্থা ছিলোনা বিধায় তাকে পাশের তিনতলা বাড়ির সিঁড়ির নিচে শুতেন। সে বাড়ির ভাড়াটিয়া এক পুলিশ ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহ তাকে নিজের ঘরে স্থান দেন। নজরুলের লেখাপড়া প্রতি আগ্রহ দেখে তিনি তাকে ময়মনসিংহ জেলার কাজী সিমলা গ্রামে বড়ভাই সাখাওয়াতউল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গের এই পাড়াগাঁয়ে নজরুলের ছাত্রজীবন দীর্ঘ হয়নি,স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েই তিনি ছুটলেন নিজ দেশে। এরপর আসানসোলের কাছে রানীগঞ্জ শিয়াড়শোলরাজ হাইস্কুলে ভর্তি হোক ক্লাস সেভেনে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করায় ডবল প্রমোশন পেয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। থাকতেন-রায় সাহেবের ফুলবাগানের পাশে ছোট একটা মাটির ঘরে। ঘরটির নাম-মহমডেন বোর্ডিং। নিজের খরচের জন্য শিয়াড়শোল রাজবাড়ী থেকে মাসিক সাতটাকা বৃত্তি পেতেন। এখানে বসেই নজরুলকে লিখতে হয়েছে অসখ্য ফরমায়েশি কবিতা।
এখানে তিনি ছিলেন মোট তিন বছর -১৯১৫সাল থেকে ১৯১৭সাল পর্যন্ত। চালচুলোহীন, পরের অনুগ্রহে –অবহেলা অনাদরে কাটানো জীবনের দুঃসহ জীবনের কারণে বিদ্রোহ হয়ে উঠে তাঁর মন । ঐ সময়ে ১ম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল এবং ভারতবর্ষে চলছিল স্বদেশী আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। অভাব অনটনের তীব্র কষাঘাত আর হিন্দু সহপাঠী বন্ধু এবং শিক্ষকের কল্যাণে নজরুলেরও মনে জেগে উঠে-দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াতে হবে। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে এসে গায়ের জোর আর অস্ত্রের জোরে আমাদের দেশ থেকে টাকা লুটছে আর সেই টাকা দিয়ে সাজাচ্ছে নিজেদের দেশকে। আমাদের দেশে এসে আমাদেরকেই গোলাম বানিয়ে নিজেরা হয়ে বসেছে প্রভু। তাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দিতে হবে সন্ত্রাস আর আন্দোলন দিয়ে।
সন্ত্রাসবাদী দল যুগান্তর আর অনুশীলন কর্মী হতে হলে নিয়ম ছিল-গীতা হাতে করে ঠাকুরের সম্মুখে তরবারি নিয়ে পরিপূর্ণ হিন্দু পদ্ধতিতে দীক্ষা নিতে হত। দেশের স্বার্থে স্বধর্মের বিশ্বাস এবং বন্ধন ছিন্ন করে নজরুল ঐ যুগান্তরে নিজকে যুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তা করেও তখনও নজরুলের লেখা কবিতা অমুসলিম সমাজে তেমন গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। নজরুল যতই তাঁর ধর্মীয় উদারতা বা তাঁর ধর্মের মস্তক মুণ্ডন করেন না কেন সে সময়ে ভারতের অমুসলিম সমাজের গভীরে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় গেড়ে বসেছিল। মুসলিমরা সে সময় অমুসলিমদের সাথে মিশে যেতে চেষ্টা করলেও অমুসলিমরা সে ভাবে মুসলিমদেরকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলোনা বা ইচ্ছা ছিলোনা। তখন অমুসলিমদের কাছে মুসলিমরা কেমন ছিল, তা ডক্টর শহীদুল্লাহর ভাষায় জেনে নেই- “আমরা কয়েকজন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য ছিলাম। সেখানে হিন্দু মুসলিমের কোন ভেদ না থাকলেও আমরা ছিলাম বড়লোকের ঘরে গরীব আত্মীয়ের মত তার সভায় যোগদান করতাম”।
দারিদ্র্যতার কারণে ১৯১৭ খৃঃ দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নের পর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ত্যাগ করতে হয়েছিল। দারিদ্র্যতার তাড়নায় রেলের গার্ডের বাসার চাকরী করতে হয়েছিল, এরপর তিনি সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক হিসাবে যোগ দেন। ল্যান্স নায়েক থেকে হাবিলদারে পদে উন্নত হয়েছিলেন। ১৯২২ খৃঃ সেনাবাহিনী থেকে চাকুরী ছেড়ে দেন। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন অবসর সময়ে তিনি লেখালেখির কাজে ব্যয় করেন।
কলিকাতায় ফিরে এসে এখানে সেখানে থাকেন । এই সময়ে তিনি আগন্তুক হিসাবে উল্কার বেগে বাংলা সাহিত্যে সাংবাদিকতার জগতে বাংলা গানের জগতে প্রবেশ করেন। সব্যসাচীর মত হাল ধরেন নতুন যুগের কবিতা,গান, রাজনীতির-সাংবাদিকতার। একে একে বের হতে থাকে নজরুলের কলম থেকে-‘শাতিল আরব’‘খেয়াপারের তরণী’ ‘কামাল পাশা’ ‘বিদ্রোহী’- প্রভৃতি একের পর এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। রীতিমত হৈ চৈ পড়ে গেলো। রাতারাতি নজরুল এতোই বিখ্যাত হয়ে গেলেন যে তাঁকে ‘বিদ্রোহীকবি’ উপাধিতে ভূষিত করলো ভক্ত পাঠকবৃন্দ। এক সময় তিনি ‘দৈনিক সেবক’ ‘দৈনিক আজাদ’ মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের ব্যবহার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এসব পত্রিকার চাকরী ছেড়ে নিজেই দুটি পত্রিকা—‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙল’ প্রকাশ করেন। ধূমকেতুতে নজরুলের একটি কবিতায় ভীরুদের প্রতি ধিক্কার, ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ঘৃণা আর দেশ প্রেমীদের প্রতি বিদ্রোহের ডাক—প্রকাশিত হয়। ফল যা হবার তাই হল। ধূমকেতুর অফিসসহ পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হল আর দেশদ্রোহীর অপরাধে কবির ভাগ্যে জুটলো এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। কবিতা লেখার জন্য কারাবরণ কোন বাঙালী কবির ভাগ্যে এই প্রথম ঘটলো।
নজরুলের প্রচণ্ড লেখনী প্রতিভা থাকা স্বত্বেও তাঁর লেখায় অমুসলিম মানসে কোন প্রকার আঘাত না দিয়ে লিখে গেছেন বরং সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি কলম ধরে গেছেন। দেশের ঐক্যের জন্য ইংরেজ বিতানের জন্য তিনি স্বধর্মের বিরোধিতা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। অন্য দিকে কোরান,হাদিস ও আলেম সমাজকেও আঘাত দিয়ে গেছেন অনেক ক্ষেত্রে। তবুও তিনি তাঁদের কাছ থেকে আশানুরূপ সমর্থন লাভ করতে পারেননি।
মোহিত লালের ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে নানা ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করে লেখা প্রকাশ করা হয়। তবুও নজরুল আঘাতের পরিবর্তে পালটা আঘাত না করে তাঁদের প্রতি আরও নমনীয় হলেন। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে মুগ্ধ করতে তাঁদের ঠাকুর দেবতাদের কথা দিয়ে, রামায়ণ মহাভারতে কাহিনী দিয়ে, প্রাচীন মুনি ঋষি কথার ঠাসা সম্ভার দিয়ে একের পর এক কবিতা লিখে যেতে থাকেন। এবার প্রতিবেশী সমাজের অনেকেই তাঁর উপর দৃষ্টি দিলেন। কিন্তু তা নজরুলের কাছে যথেষ্ট মনে হলনা। এবার নার্গিসকে তালাক দিয়ে শ্রীযুক্তা গিরিবালা দেবীর কন্যা প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন।
এরপর নজরুল আরও নমনীয় হতে আরও নেমে এলেন পূর্ব পুরুষের ধর্মীয় গণ্ডির সীমা থেকে। নামাজ রোজা আড়াল করে দিলেন। তাঁর পুত্রদের হিন্দু কায়দায় নাম রাখলেন। ছেলেদের এমন পরিবেশে মানুষ করলেন যাতে তাঁর পুত্ররা মুসলিম পাত্রীদেরকে বিয়ের কথা কল্পনা করতে না পারে। ছেলেরা বড় হল পুরো হিন্দু কায়দায়, হিন্দু মেয়ে বিয়ে করলেন। তাঁদের ছেলে মেয়েদের নামও হিন্দুদের মত করে রাখলেন। এই সব কার্য কলাপ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে তিনি পুরো মুসলিম সমাজ থেকে বের হয়ে আসতে চান।
এরপর নজরুল দেবতা ভক্ত হয়ে গেলেন, কালী দেবীর নামে অনেক ভক্তিমূলক শ্যামাসংগীত লিখতে লাগলেন, তাতে সুর লাগালেন, নিজে ভাবের সাথে গেয়েও শোনালেন। এরপর নজরুল আরও নেমে এলেন- কালী সাধনায় তিনি লেগে গেলেন।
করুণাময় গোস্বামী (১৯৭৮:৭৮-৮০) বলেন, নজরুল এক পর্যায়ে কালী-সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। আজহার উদ্দিন জানিয়েছেন: ‘বাড়ীর চিলে কোঠায় কালী প্রতিমা স্থাপন করে সকাল সন্ধ্যা মন্ত্রজপ করতে শুরু করলেন। কোন কোন বার নিরম্বু উপবাস করে ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে পূজা গৃহে দিন দুই কাটিয়ে দিতেন।’ কমলাদাশগুপ্ত জানিয়েছেন: ‘গিরিবালা দেবীর ঠাকুর ঘরে দশভূজা শ্যামা মূর্তির পট ছিল। রাঙাদির (প্রমীলা) অসুখের শুরুতেই নজরুল সকালে স্নান করে পট্টবস্ত্র পরিধান করে চণ্ডীপাঠ করতেন।’
এরপরও যারা বলবেন যে, শ্যামা সঙ্গীত রচনা কবির প্রাথমিক সময়ের ফরমাশি লেখা, তাদের জন্য আনন্দ বাজার পত্রিকা থেকে কিছু অংশ তোলে দিলাম। কবি প্রথম জীবনে কি শেষ জীবনে কি বিশ্বাস ধারণ করতে এই অংশ থেকে যারা বুঝা বুঝতে পারবেন আর যারা বুঝা নয় তা বুঝতে পারবেনা।
(বহরমপুরের অভিজাত ‘সান্যাল বাড়ির’ নলিনাক্ষ সান্যালের বন্ধু ছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে নজরুল বহরমপুরে আসেন এবং বরযাত্রীও গিয়েছিলেন। সেখানে অন্য বরযাত্রীদের থেকে দূরত্ব রেখে নজরুল ইসলামকে খেতে দেওয়া হয়। নলিনাক্ষ সান্যালের ভাই শশাঙ্কশেখর সান্যাল ওই দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে দাদাকে বিয়ের মঞ্চে গিয়ে বলে যে, ‘দাদা ওরা কাজিকে অপমান করেছে। এই বিয়ে হবে না, তুই চলে আয়।’ তখন নজরুল বুঝিয়ে শান্ত করেন। এর পরে বিয়ে শেষে ভোরের দিকে উঠোনে চেয়ারে বসে বাড়ির কর্তা শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্যের তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে এসেছেন। সেই সময়ে তিনি শুনতে পান সুমধুর কন্ঠে কেউ এক জন শ্যামাসঙ্গীত গাইছে। খড়ম পায়ে উঠে গিয়ে তিনি দেখেন–বাড়ির কালীমন্দিরে বসে চোখ বন্ধ করে নজরুল গাইছেন আর তাঁর চোখ দিয়ে জল ঝরছে। পর দিন দুপুরে যখন বরযাত্রীদের খেতে দেওয়া হয়, সেখানে অন্যদের সঙ্গে নজরুলেরও খাবার জন্য পাতা দেওয়া হয়েছে। শশাঙ্ক সান্যালের ডান দিকে বসেছিলেন নজরুল। আচমকা শশাঙ্কবাবু বলে ওঠেন‘কাজি এখন খাবে না। পরে খাবে। হারমোনিয়াম নিয়ে এসো। কাজি গান গাইবে।’ নজরুল ইসলাম তখন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব/ জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া’, গানটি করেন।) দেখুন- http://www.anandabazar.com/archive/1121116/16mur3.html
ঠিক বেঠিক হোক নজরুল হিন্দু-মানসে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের সব কিছু ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারেননি। সারা জীবন শুধু ঋণ করে গেছেন আর বুকের বেদনা ভুলতে মদপান করে গেছেন।গান গেয়ে হাসির আবরণে সুপ্ত কান্নার মিনার গড়েছেন। নিজের বংশ ধ্বংস হওয়ার দিকে দৃষ্টি দিতে ফুসরত পাননি।
১৯৪১ সালের ৫ই ও ৬ই এপ্রিল কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির রজত-জয়ন্তী উৎসবে সভাপতির ভাষণ দিলেন কবি, হঠাৎ এক জায়গায় নিজের সম্পর্কে বললেন,
‘যদি আর বাঁশী না বাজে, কবি বলে বলছিলেন,- আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, নেতা হতে আসিনি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।
এরপর ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে কলকাতা বেতারে ছোটদের গল্পের আসরে কবি গল্প বলতে বলতেই রুদ্ধ কণ্ঠ হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে তাঁর দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লো-সমস্ত চিকিৎসা ব্যর্থ করে দিয়ে। এরপর ভক্তি মাল্য ঝরতে লাগে জ্ঞান হারা কবির উপর। আজ কবি পুত্র, পৌত্র ও কন্যাদের হিসাবের অংক বড় জটিল হয়ে পড়েছে- না তাঁদের মুসলিমত্ব কোন মর্যাদা আছে, না তাঁরা পরিপূর্ণ হিন্দু হতে পেরেছেন। ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল এই সুদীর্ঘ চৌত্রিশ বছর কবি বেঁচেছিলেন জীবন্মৃত হয়ে।
১৯৭৫ সাল থেকেই কবির স্বাস্থ্য অবনতির দিকে যেতে থাকে। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট, বাংলা ১৩৮৩ সনের ১২ই ভাদ্র রবিবার ব্রংকোনিমোনিয়ায় কবি ঢাকার পি.জি. হাসপাতালে ছিয়াত্তর বছর বয়সে মৃত্যু বরন করেন। ঐ দিনই তাঁর মর দেহ দাফন করা হয় ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে।
তাঁর জন্ম হয়েছিল পুরোপুরি মুসলিম পরিবেশে, মুসলিম মা বাবার সন্ধিক্ষণে। তাঁর মৃত্যুর পর মুসলিম পদ্ধতিতে তারও তাঁর স্ত্রীর কবরও দেওয়া হলেও এটা কবির দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকে গেল।
পাঠক উপরের লেখাকে নজরুলের ইতিহাস বলে ধরে নিবেন না। আগামী দিনের নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদরাই নির্ণয় করবেন নজরুল ইসলামের সত্যিকারের ইতিহাস।
[বিঃদ্রঃ এই লেখাটি আমার কোন মৌলিক লেখা নয়। এই লেখা গোলাম আহমদ মোর্তজার চেপে রাখা ইতিহাস থেকে কাজী নজরুল ইসলাম প্রবন্ধের সম্পাদিত অনুলিপি এবং ফেসবুকের কাজি মামুনের লেখার কিছু তথ্যে সন্নিবেশিত করেছি মাত্র।

No comments:

Post a Comment